তালিপাম


তালিপামগাছের এ প্রজাতিটি প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯১৯ সালে। ব্রিটিশ অরণ্যতরু সন্ধানী উইলিয়াম রক্সবার্গ এই প্রজাতিটির সন্ধান পান ভারতের পূর্বাঞ্চলে। তিনি এর নাম দেন ‘করিফা তালিয়েরা’ (Corypha taliera)। পরে এর বৈজ্ঞানিক নাম হয় কারিফা তালিয়েরা রক্সবার্গ। 

বাংলায় গাছটিকে ‘তালি’ বা ‘তালিপাম’ নামে ডাকা হয়। গাছটি দেখতে অবিকল আমাদের চেনা তালগাছের মতো হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি একটি ভিন্ন প্রজাতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এ গাছটি প্রথম শনাক্ত করেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী শ্যামল কুমার বসু।

পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা—আইইউসিএন বলেছে, একই প্রজাতির আরেকটি গাছ ছিল ভারতের হাওড়ায়, জাতীয় বোটানিক্যাল গার্ডেনে। তবে সেটি প্রাকৃতিক পরিবেশে নয়, উদ্যানে জন্মানো গাছ। সেটির ফুল ফোটার পর তার বীজ সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে আইইউসিএনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রাকৃতিক পরিবেশের সর্বশেষ তালিপামটি ছিল পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনের পাশের একটি গ্রামে। গাছের মাথায় শিংয়ের মতো ফুল গজায় বলে এটিকে গ্রামবাসী ‘ভূতের গাছ’ নাম দেয়। পরে গ্রামবাসী গাছটি কেটে ফেলে। ফলে সে গাছ থেকে কোনো বীজ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃতপ্রায় মা-গাছটির পুষ্পমঞ্জরি দণ্ড দেখা দেয় ২০০৮ সালে। এরপর তা থেকে ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে মরণ-ফুল ফোটে। এর পরপরই শুরু হয় তার মরণ-প্রক্রিয়া। এর মধ্যেই সেই ফুল থেকে হয় ফল। সেই ফল থেকে পাওয়া বীজগুলো সংরক্ষণ করে শুরু হয় চারা গজানোর প্রক্রিয়া। 

বিলুপ্তির শঙ্কা থেকে মুক্ত হয়ে আবারও পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় তারা। পাশেই হতশ্রী চেহারায় এখনো দাঁড়িয়ে আছে মা-গাছটি। ‘মরণ-ফুল’ ফোটার পর তার সবুজ ডালগুলো শুকিয়ে খয়েরি বর্ণ ধারণ করেছে। কিন্তু চিরবিদায় নেওয়ার আগেই উদ্ভিদ-বিজ্ঞানীদের সব শঙ্কা মুক্ত করে গেছে সে। গাছটির নাম ‘তালিপাম’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যের বাংলোয় অবস্থিত প্রাকৃতিক পরিবেশে জন্মানো পৃথিবীর সর্বশেষ এ গাছটির বংশ বিলুপ্ত হওয়ার আর কোনো শঙ্কা নেই। বাংলোর মালি জাহাঙ্গীর আলম নিরলস প্রচেষ্টায় একমাত্র গাছটির চারা গজাতে সক্ষম হয়েছেন।ছোট ছোট টবে তালগাছের চারার মতো গাছগুলো ঝোপবেঁধে রয়েছে। মাটিতেও সারবেঁধে গজিয়েছে অনেকগুলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ‘গাছটির যখন ফুল ফুটেছিল, তখন এর প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে আমরা আশঙ্কা করেছিলাম। কারণ ফুল ফোটার পরপরই গাছটি মারা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ীও এ গোত্রের প্রজাতিগুলোর বীজও সচরাচর অঙ্কুরিত হয় না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে এ তালিপামগাছটির সব বীজের চারাই অঙ্কুরিত হয়েছে।’

হাদিউজ্জামান আরো বলেন, গাছটির প্রায় ৫০০ চারা গজিয়েছে। চারাগুলো বন বিভাগসহ বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় পরিকল্পিত উপায়ে বিভিন্ন জায়গায় লাগানো হবে। এরপর গাছগুলো কী অবস্থায় থাকে তাও পর্যবেক্ষণ করা হবে।
টিস্যুকালচার পদ্ধতিতে তালিপামগাছের চারা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু জাহাঙ্গীর আলম বীজ রোপণ পদ্ধতিতেই চারা তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বলেন ‘বীজগুলো সংরক্ষণের পর ভিজিয়ে রেখেছিলাম দুই-তিন দিন। তারপর নরম মাটির চার-পাঁচ ইঞ্চি গভীর গর্ত করে পুঁতে রাখি। তিন-চার মাস পরে দেখি শেকড় গজিয়েছে। তারপর দেখি পাতা গজিয়ে গেছে।’

বিশিষ্ট প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা প্রথম আলোকে বলেন, এটা আমাদের সৌভাগ্য যে চারা সহজেই গজিয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিলুপ্তপ্রায় তালিপাম চারার একমাত্র মালিক। প্রজাতিটিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url