শকুনের শত্রু গবাদিপশুর ওষুধ

মৃত প্রাণীর মাংস প্রধান খাদ্য হওয়ায় মানুষের কাছে শকুন অমঙ্গলের প্রতীক। দুর্ভিক্ষ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি হলে শকুনের দল এসে ভিড় করত। ‘তোর বাড়িতে শকুন পড়ুক’—এমন কথা একসময় কাউকে অভিশাপ দেওয়ার জন্য বলা হতো। তবে প্রাণীর মৃতদেহ খেয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে বলে প্রকৃতিবিদেরা শকুনকে পরিবেশের বন্ধু হিসেবেই চিহ্নিত করে থাকেন। এর মধ্যে ‘হোয়াইট-রাম্পড ভালচার জিপস ব্যাঙ্গালেনেসিস’ অর্থাৎ বাংলা শকুনের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া।
বাংলা শকুন বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে। গবেষকেরা বলছেন, সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশে আর শকুন দেখা যাবে না। বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, গত দুই দশকে দেশে শকুনের সংখ্যা দেড় লাখ থেকে কমে দুই হাজারে নেমে এসেছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন ফর নেচারের (আইইউসিএন) হিসাবে গত এক যুগের মধ্যে শকুন চরম বিপদাপন্ন প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।
মাত্র এক দশক আগেও কোথাও প্রাণীর মৃতদেহ পড়ে থাকলেই বাংলা শকুনের দল একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ত। পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত প্রাণীর মৃতদেহ খেয়ে সাবাড় করত। শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মৃত প্রাণী এখন ইঁদুর আর লাওয়ারিশ কুকুরের খাবারে পরিণত হচ্ছে। অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা ও খুরারোগের জীবাণু শকুনের পেটে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু ইঁদুর বা কুকুরের দেহে গেলে তা মানুষ ও অন্য প্রাণীর দেহে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এই প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ খর্ব হওয়ায় এখন জলাতঙ্ক রোগ বেড়ে গেছে। শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের মতো জনাকীর্ণ দেশে এখন মহামারির (প্যানডেমিক) আশঙ্কা বাড়ছে।
প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক অনেক বছর আগে বনের মৃত প্রাণীই ছিল শকুনের প্রধান খাবার। বন ধ্বংস হওয়ার পর শকুনের দল মানববসতি এলাকায় মৃত প্রাণীর খোঁজে আসতে শুরু করে। বিশেষ করে দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানির পর গাছে গাছে শকুনের দল দেখা যেত। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত মৃত প্রাণী খেয়ে সাবাড় করে প্রকৃতির পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে ভূমিকা রাখত।
শকুন কমছে: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে শকুনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে তাদের আবাসভূমি ও খাদ্যসংকটকে দায়ী করেন। সম্প্রতি গবাদিপশুর ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহূত হওয়া ডাইক্লোফেনাকের কারণে সবচেয়ে বেশি শকুন মারা যাচ্ছে বলে জানান তিনি। আশির দশকের শেষ দিকেও ঢাকার হাজারিবাগের কসাইখানায় শকুনের ঝাঁক দেখা যেত।
আনোয়ারুল ইসলামের মতে, আশির দশকেও দেশের প্রতিটি গ্রামে কমপক্ষে ২০০ শকুন ছিল। বেশির ভাগ গ্রাম ও পাড়ায় ভাগাড় (ময়লা ও মৃত প্রাণী ফেলার নির্দিষ্ট স্থান) থাকত। শকুনের দল গ্রামের বড় গাছগুলোতে বসবাস করত আর ভাগাড় থেকে খাদ্য সংগ্রহ করত। বর্তমানে বেশির ভাগ গ্রামেই ভাগাড় নেই। বনের সংখ্যাও কমে গেছে। বর্তমানে সরা দেশে শকুনের সংখ্যা বড়জোর দুই হাজার হবে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ বন্য প্রাণী ট্রাস্টের (ডব্লিউটিবি) পর্যবেক্ষকেরা ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে লাউয়াছড়ার পাশের কালাছড়া বনে গিয়ে ৪৬টি শকুনর দেখা পান। চলতি বছরের আগস্টে একই এলাকায় গিয়ে তাঁরা মাত্র ছয়টি শকুন দেখেছেন। বাংলাদেশে দেখা যেত সাত প্রজাতির শকুন। এর মধ্যে হিমালয়ান গ্রিফন, লং বিল্ড শকুন, কালো শকুন, রাজ শকুন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
রিসার্চ অ্যান্ড কনজারভেশন প্রোগ্রাম অব বাংলাদেশ ২০০৯ সালে বাংলাদেশের শকুনের মৃত্যুর ওপর একটি গবেষণা ও জরিপ চালায়। ‘স্টেটাস সার্ভে অ্যান্ড আইডেনটিফিকেশন অব কি এরিয়াস ফর দ্য কনজারভেশন অব হোয়াইট-রাম্পড ভালচার জিপস ব্যাঙ্গালেনেসিস ইন বাংলাদেশ’ নামের এই সমীক্ষায় দেখা যায়, গবাদিপশুর ক্ষেত্রে ব্যথানাশক ডাইক্লোফেনাক ওষুধের কারণে শকুন মারা যাচ্ছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৫৭ শতাংশ গবাদিপশুর মালিক ডাইক্লোফেনাক ব্যবহার করেন। এই পশু মারা যাওয়ার পর তার মৃতদেহ খেয়ে শকুন মারা যাচ্ছে।
ঘাতক ডাইক্লোফেনাক: ২০০৩ সালে ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভারসিটি কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিনে গবেষণারত লিন্ডসে ওক সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন যে ডাইক্লোফেনাক শকুনের কিডনি নষ্ট করে এবং মৃত্যু ঘটায়। ব্যথানাশক ওষুধ ডাইক্লোফেনাক গরু-ছাগলের দেহে ব্যবহার হওয়ার পর ওই প্রাণী মারা যাওয়ার পর এর মৃতদেহ খেলে শকুনের কিডনি বিকল হয়ে যায়।
স্তন্যপায়ী প্রাণীকে ডাইক্লোফেনাকের যে ‘ডোজ’ দেওয়া হয়, তার মাত্র ১০ শতাংশ দিলেই শকুন মারা যায়। তাই ওষুধটি অতি অল্প ব্যবহূত হলেও পরিবেশে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
ভারতের বন বিভাগের হিসাবে, আশির দশকে ভারতে চার কোটি শকুন ছিল। চলতি বছর তা ৪০ হাজার টিকে আছে। ভারতেও বাংলা শকুনের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি ছিল। ডাইক্লোফেনাকের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই প্রজাতি।
২০০৬ সালের মে মাসে ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল ডাইক্লোফেনাক প্রস্তুত করার লাইসেন্স প্রত্যাহার করে এবং পশুর চিকিত্সায় ক্রমান্বয়ে ‘মেলোক্সিক্যাম’ ব্যবহার করার জন্য নির্দেশ দেয়। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করে বিকল্প ওষুধ মেলোক্সিক্যাম তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে নেপাল সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পশুর চিকিত্সায় ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করে মেলোক্সিক্যাম ব্যবহারের নির্দেশ দেয়।
ভারতের আসামে শকুনের একটি প্রজননকেন্দ্রও গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো ব্যথানাশক ও জীবাণুনাশক হিসেবে এই ওষুধ ব্যবহূত হচ্ছে। শকুন সংরক্ষণে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। এভাবে চলতে থাকলে এই দেশ থেকে একসময় বাংলা শকুন চিরতরে শেষ হয়ে যাবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url